০১.
পাঁচ বছর আগের কথা। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে দীঘিনালা-মারিশ্যা সড়কের কাজ মাত্রই শুরু হয়েছে। কাসালং ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে সবে। তথাকথিত 'পরিদর্শনে' গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। এইসবের কিছুই নয়- আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল সেই 'নিষিদ্ধ এলাকা'- সাজেক! দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সেবার বাঘাইছড়ির মারিশ্যার পর আর বেশিদূর এগোতে পারিনি। ওপরের দুটি ছবি পাঁচ বছরের আগের। হার্ডডিস্ক থেকে খুঁজে পেতে বের করলাম।

০২.
পাঁচ বছরের মাথায় সাজেকের হাতছানি আর এড়ানো গেল না। এর মধ্যে কত জল কাসালংয়ের নিচ দিয়ে গড়িয়ে গেছে। কতো কী ঘটে গেছে। আমাদের ছয় সদস্যবিশিষ্ট দলটির লক্ষ্য, সাজেক! সবার মনে একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব। আমাদের এক সঙ্গীর জন্ম বাঘাইছড়িতে। অথচ সে-ই কিনা তার উপজেলার একটি ইউনিয়ন সাজেকে যায়নি!

খাগড়াছড়ি হয়ে বাঘাইছড়িতে নামি। সেখানে জেলা পরিষদের রেস্ট হাউস খালিই ছিল। কিন্তু ইউএনও থাকার অনুমতি দিতে গাইগুই করেন। পরে স্থানীয় প্রেসক্লাবের তৎপরতায় থাকার অনুমতি মেলে। ওপরতলায় সর্বডানের কক্ষে আমার জন্য বরাদ্দ হল।

দুপুরে বাঘাইছড়ি সদরে সাজেক ইউপির চেয়ারম্যান এলতেঙ্গা কথা দিয়েছিলেন, আমাদের সঙ্গে যাবেন। উপযাচক হয়ে সন্ধ্যায় বিডিআর ব্যাটালিয়নে যাই দিকনির্দেশনা নিতে। কর্তব্যরত মেজর জানালেন এলতেঙ্গার কাছ থেকে তিনি আমাদের কথা শুনেছেন। তিনি আশ্বাস দিলেন, সাজেক ক্যাম্পে বলে দেবেন। তবে বারবার সাবধান করে দিলেন, রুইলুই পাড়ার পর এক পাও না আগাতে। পরদিন সকালে দেখি এলতেঙ্গা বেঁকে বসেছেন- তার নাকি কী এক সমস্যা আছে। তবে বললেন, পরেরবার আসলে তিনি নাচগানের আয়োজন করবেন। অগত্যা কী আর করা!
পরদিন সকালে বাঘাইহাট থেকে একটি জিপ ভাড়া করি। সাজেকে যাওয়া-আসার ভাড়া তিন হাজার টাকা। তাও যেই সেই জিপ না, রীতিমতো ডাবল ইঞ্জিন।


০৩.
সেই গাড়ি চলছে তো চলছেই। হৃৎপিন্ডই নড়ে উঠে, এমন ঝাঁকুনি। এবড়োথেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা। ভয়ংকর খাড়া পথ বেয়ে ওঠানামা। চলতিপথে বহুবার এমন দেখেছি- গাড়ি নামছে, কিন্তু ঢালু সেই পথের শেষটা চোখে দেখা যায় না। ভয়াবহ সব বাঁকের কথা সবল হৃৎপিন্ডের অধিকারী লোককেও ভয় পাইয়ে দেবে নিশ্চিত।
চুলচেরা হিসাব করে দেখিনি ঠিক, তবে পথে পথে গাড়ি থামিয়ে কমপক্ষে ২০টি সেনাক্যাম্পে হাজিরা দিতে হয়েছে। প্রতিটিতেই অপেক্ষা করছিল দুর্ভোগ। কেন যাচ্ছি, কতোক্ষণ থাকবো- সবখানেই একই জিজ্ঞাসা। সবখানেই অসহ্য প্রতীক্ষা।
যাওয়ার পথে দুইছড়ির আগে একটা সেনাক্যাম্পের সামনে সব গাড়ি থেমে গেল। যাত্রীরা একে একে বের হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। যেন এটাই নিয়ম! ক্যামেরাটা নিয়ে আমি একটা ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করলাম। সামনে সবুজে ছাওয়া পাহাড় আর পাহাড়।

০৪.
কাসালং ব্রিজের আগে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের একটা বড়ো ক্যাম্পে এসে চতুর্থবারের মতো বাধাপ্রাপ্ত হই। এবারের বাধাটা বেশ কঠিন- সামনে যেতে দেবে না কিছুতেই। প্রখর রোদে গাড়িতে বসতেও দিল না আমাদের কাউকেই। বিরক্তি লাগছিল প্রচন্ড। সাহস করে নেমকার্ড দিলাম একজনের হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক পড়ল- একটু আশার আলো। ভেতরে গিয়ে অন্য দৃশ্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণ মেজর সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, পথে পথে দেখবেন আমাদের লোকজন সড়কের কাজ করছে। বহু হিসাবনিকাশ দিলেন, একটি মানচিত্রও দেখালেন- সেখানে কী কাজ তারা করছেন। আমি বিস্মিত হওয়ার ভান করে যাই আগাগোড়া- আসাধারণ কাজ আপনাদের! মেজর পুরো বিগলিত। আবার ছুটল গাড়ি।


০৫.
জনমানবহীন এবং অস্বাভাবিক নিরব এই পথে এক অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হলাম হঠাৎই। পাহাড় কেটে মাটি সমান করছিল একটি ট্রাক্টর, চালক এক সেনাসদস্য। ক্যামেরা বের করতেই পাশের ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চার মূর্তি- হাতে রাইফেল। অন্য অস্ত্রও হতে পারে, অতো নিচ থেকে খেয়াল করার উপায় নেই। নির্দেশমতো আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা সবাই। নানা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আগের ক্যাম্পের মেজর সাহেবের রেফারেন্স দিয়ে ছাড়া পেলাম। সাজেক তখনো অনেক দূর।

বিডিআরের কড়া নজরদারি এড়িয়ে কিভাবে কিভাবে যেন রুইলুইপাড়ার পথে এগিয়ে গেল আমাদের গাড়ি। কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ পাহাড়ের নিচ থেকে বেরিয়ে এল দুই তরুণী। সঙ্গে শুকনো হলুদের বোঝা। তাদেরকে তুলে নিই আমাদের গাড়িতে।

সামনে উঁচু পাহাড়ের ওপর কমলাকপাড়া...

প্রথম প্রকাশ  |  দ্বিতীয় প্রকাশ

0 Comments

Add Yours